লেন মানে না গাড়ি, নিয়ম ভাঙে যাত্রী-পথচারী
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগসূত্র জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী রাস্তার ডান পাশে থাকবে প্রথম লেন। মাঝখানে দ্বিতীয় আর বাঁ পাশে থাকবে তৃতীয় লেন। প্রথম লেনে কার, মাইক্রোবাস, জিপ ও ভিআইপিদের গাড়ি চলবে। যেসব গাড়ি সামনে গিয়ে ডানে মোড় নেবে সেগুলো এই লেনে থাকবে। মাঝখানের দ্বিতীয় লেনে চলবে বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। তৃতীয় লেনে অটোরিকশা, হিউম্যান হলার ও টেম্পো চলবে। যেসব গাড়ি সামনের ক্রসিংয়ে বাঁয়ে মোড় নেবে সেগুলো এই লেনে থাকবে। লেনে চলার সময় ওভারটেক করা নিষেধ। যত্রতত্র ইচ্ছামতো লেন পরিবর্তন করা যাবে না। সামনের ক্রসিংয়ে বাঁয়ে বা ডানে মোড় নিতে হলে গাড়িটিকে আগেই বাঁয়ের বা ডানের লেন ধরে চলতে হবে। আর ক্রসিংয়ে বাঁয়ের বা ডানের লেন আটকে না রাখতেও নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। নির্ধারিত স্টপেজের বাইরেও মাঝ রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে যাত্রী তোলা, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, রেষারেষি করে গাড়ি চালাতে গিয়ে জটলা তৈরি করে অহরহ যানজট সৃষ্টির নানা অব্যবস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়। আবার চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে পথচারীদের হঠাৎ দৌড়ে রাস্তা পারাপার, ফুটওভার ব্রিজ এড়িয়ে ঝুঁকিতে পথ পেরোনোর ঘটনাও রোধ হচ্ছে না কোনোক্রমেই। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী পথচারীদের জরিমানার দন্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। তবু যাত্রী-পথচারীদের ট্রাফিক আইন ভঙ্গের প্রবণতা রোধ করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহল বলছেন, ‘পরিবহন অরাজকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন সবাইকেই আইন মান্য করতে হবে। সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস্তাসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। আমাদের দেশে আইন না মানার মানসিকতা দেশ স্বাধীনের পর থেকেই চলে আসছে। আইন না মানার প্রবণতা ক্ষমতা দেখানোর মানসিকতায় পরিণত হয়েছে। কেউ আইন না মানলে নিজেকে বড় কিছু মনে করেন। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের মাধ্যমে কীভাবে আইন মানতে হয় বা আইন মেনে চললে কীভাবে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসে তা চোখে আঙ্গুল গিয়ে দেখিয়ে দিলেও তা থেকে আমরা কেউই শিক্ষা নিতে পারিনি।’
নতুন আইনের কঠোর প্রয়োগেও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। ফলে দুর্ঘটনাও কমছে না। দিন দিনই বেড়ে চলেছে যানজটের দুঃসহ যন্ত্রণা। সড়ক-মহাসড়কে নেই যথাযথ লেন মার্কিং। ফলে খোদ রাজধানীতেই গাড়িগুলো লেন মেনে চলছে না। রাস্তার মধ্যে গাড়ি থামিয়েই যাত্রী ওঠানো-নামানো চলছে যত্রতত্র। যাত্রী-পথচারীরাও মানছেন না ট্রাফিক নিয়ম। কানে মোবাইল লাগিয়ে রাস্তা পারাপারে পথচরীরা এতটাই বেপরোয়া যে, দ্রুতগামী গাড়ি কড়া ব্রেক কষে থেমে যেতে বাধ্য হয়। আগে যাওয়ার প্রবণতায় গাড়িগুলোর মধ্যেও চলে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা। ব্যস্ততম রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে বাস-মিনিবাসের ঝুঁকিপূর্ণ রেসিংয়ের ঘটনায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, হতাহত হচ্ছেন যাত্রী-পথচারী। এমন হাজারো জঞ্জাল-বিশৃঙ্খলায় সড়কের নৈরাজ্য কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। দুই বাসের রেষারেষিতে চাপা পড়ে হাত হারিয়েছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। তিনি কয়েক দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন। এর তিন দিন না যেতেই বাসচাপায় মেরুদন্ড ভেঙে গেছে গৃহিণী আয়েশা খাতুনের। মৃত্যু অবধি হামাগুড়ি দিয়েই তার জীবন পার করতে হবে। আর কখনোই দাঁড়াতে পারবেন না। এমন দুর্ঘটনার পরও থেমে নেই চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো। শুধু রাজীব বা আয়েশা নন, প্রতিদিন রাজধানীতে এভাবে কাউকে না কাউকে দুর্ঘটনায় পড়তে হচ্ছে। এতে অনেকে সারা জীবনের জন্য বরণ করছেন পঙ্গুত্ব, বাধ্য হচ্ছেন দুর্বিষহ জীবন যাপনে। রাজধানীতে প্রায় দেড় যুগ ধরে ট্রাফিক সদস্যের দায়িত্ব পালনকারী একজন কনস্টেবল দাবি করেন, ‘ঢাকায় সড়ক ব্যবস্থাপনায় নানা সীমাবদ্ধতা আছে, তবু রাস্তায় লেন মেনে গাড়ি চালালে যানজটের ধকল অর্ধেকটা কমে যাবে। ট্রাফিক আইনেও যানবাহন চালনায় লেন ব্যবহারের কথা বলা আছে। কিন্তু আইনটির কোনো প্রয়োগ নেই। সড়ক বা মহাসড়কে লেন ব্যবহারের পদ্ধতি কেউই মানে না, যে কারণে এর সুফলও মেলে না।’ এদিকে যানবাহন-চালকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, সড়কে কোনো মার্কিং না করেই লেন মানার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজীপুর রুটে চলা বলাকা পরিবহনের চালক নেয়ামত উল্যাহ জানান, বিমানবন্দর সড়কে কাওলার কাছে রাস্তার মধ্যেই সাদা রঙে বড় আকারে ৪০, ৫০ ও ৬০ লিখে রাখা হয়েছে। সড়কের বাঁ পাশের প্রথম লেনে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতির গাড়ি চলবে, মাঝের লেনে ৫০ এবং সড়ক আইল্যান্ড-সংলগ্ন লেনটিতে ৬০ কিলোমিটার গতির গাড়ি চালানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সড়কের কোথাও সেই লেনকে সাদা রং দিয়ে আর আলাদা করার ব্যবস্থা হয়নি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। সিএনজিচালিত অল্প গতির থ্রি হুইলারগুলো ৪০ কিলোমিটার গতি চিহ্নিত সর্ববাঁয়ের লেনটি ব্যবহারের কথা থাকলেও সেগুলো ৬০ কিলোমিটার গতির সর্বডানের লেন ব্যবহার করে চলছে। তেমনি দ্রুতগামী দূরপাল্লার কোচ ব্যবহার করছে সর্ববাঁয়ের অল্প গতির লেন। অর্থাৎ যে যেভাবে পারছে চলছে। ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। যানজটও লেগে থাকছে রাত-দিন। এসব কারণে আইন অমান্যকারী চালকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করলেও ‘লেন অমান্যের’ অপরাধের জন্য ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এ কারণে গাড়িচালকরাও লেন মেনে চলাকে মোটেও বাধ্যতামূলক নিয়ম বলে মনে করেন না। রাজধানীর সড়কগুলোয় বড় ট্রাক-লরি, বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কার আর অটোরিকশাকে একই লেনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে দেখা যায়। দ্রুতগামী প্রাইভেট কার কিংবা অ্যাম্বুলেন্সকেও পায়ে চালানো রিকশা-ভ্যানের পেছন পেছন চলতে হয় মাইলের পর মাইল। এতে চালকরা যেমন বিপাকে পড়েন, তেমন রিকশার নেতৃত্বে চলা গাড়িগুলোরও দীর্ঘ সারি জমে সৃষ্টি হয় যানজটের।
তথ্য সুত্রঃ https://www.bd-pratidin.com